জুলাই আমারে ঝামেলায় ফালায় দিয়া গেল
(এই লেখাটা একটু বড় হচ্ছে, সময় না থাকলে স্কিপ প্লিজ)
অনেকবার অনেক ট্যাগ খাইছি। বামপন্থী ছাত্রদল, শাহবাগপন্থী ছাত্রদল, শিবিরপন্থী ছাত্রদল... এবার খাওয়ার আগেই একটা ট্যাগ নিজেই নিজেরে দিয়ে দিতে চাই। ‘সমন্বয়ক’পন্থী ছাত্রদল। মানে আগে পরে এই ট্যাগ খাইতে পারি।
সমন্বয়কপন্থী ছাত্রদল বলতে যে ছেলেগুলা ছাত্রদল হয়েও বিপ্লবীদের প্রতি প্রেম রাখে। আমার মনে হয় আমার সংগঠন আগে পরে এই সমস্যা ফেস করবেই। আন্দোলনে সরাসরি সক্রিয় থাকা কর্মীর মনস্তত্ত্ব আর আন্দোলনকে জাস্ট সাপোর্ট করা লোকের মনস্তত্ত্ব এক হবে না। যে কারণে আমি নাহিদ ভাইরে যেমনে দেখি আপনার সেভাবে দেখার চোখ নাও তৈরি হতে পারে।
খ.
ক্যান এটা হবে তা বোঝার জন্য চলেন, আমরা একটু জুলাইয়ের দিনগুলোতে ফিরে যাই। যেদিন আমি হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিসরে থরথর করে কাঁপতে দেখছি। ১৭/১৮ই জুলাইয়ের কথা বলতেছি।
(স্মৃতি থিকা লিখতেছি কিছু অস্পষ্ট হইতে পারে। এ জন্যই জুলাইয়ের ইতিহাস না হারাতে দিতে সবার ইতিহাস লেখা উচিৎ। না লিখলে ইতিহাস হাইজ্যাক হয়, রিক্রিয়েট হয় যেমনটা ৭১’ এ হইছে)
তো হ্যাঁ, ওইদিন বিকেলে ভিসি চত্বরের দিকে সাইকেলে আগাইতাছিলাম। আগেই চিন্তা ছিল শহীদ আবু সাঈদদের গায়েবানা জানাজাটা ধরবো।
আমি যখন পৌছাঁচ্ছি ততোক্ষণে জানাজা শেষ, পুলিশ-বিজিবির লাঠিপেটায় ছত্রভঙ্গ হওয়া শুরু। ফুলার রোড দিয়ে এগোলাম। ব্রিটিশ কাউন্সিল ভবনটা পার হইতেই দেখি লোকেরা ছড়ায়া ছিটায়া পড়ছে। আমি সাইকেলটা শান্ত মাথায় একটা ল্যাম্পপোস্টের সাথে বাঁধলাম। আসলে এর সঙ্গে সঙ্গেই সন্ধ্যায় আহত হওয়ার জন্য ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ কাজ করা শুরু করলো। সেই সন্ধ্যায় এমন কি খুনও হতে পারতাম।
(অদ্ভুত অদ্ভুত টাইমে আমার মাথা সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে খুব শান্তভাবে কাজ করে। যেমন ওই সন্ধ্যায় যখন ছাত্রলীগ আমারে খুন করে ফেলতে পারতো আজিজ মার্কেটের পাশের অন্ধকার গলিটাতে নিয়া। আমার মাথা খুব শান্তভাবে কাজ করা শুরু করলো। আমার ফোন চেক করার জন্য যখন হাতে নিতে চাইছিল তখন এক হাত দিয়া মাইর ঠেকাচ্ছিলাম তখন অন্য হাত পকেটে দিয়া ফোনটারে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করতেছিলাম। এইটা সুপার কুল হওয়া ছাড়া সম্ভব না।)
আচ্ছা যাই হোক, আমি এগোতেই দেখি ভিসি চত্বরে রণসাজে পুলিশ-বিজিবি। ওরা হলগুলো ছাত্রমুক্ত করতে ওপেন ফায়ার করতে করতে হলপাড়ার দিকে এগোচ্ছে। সামনে আমার পত্রিকার সহকর্মীদের একজনকে দেখলাম— নিজেকে একটু আড়াল করলাম। কারণ একজন সাংবাদিক নীতিগতভাবে আন্দোলনে অংশ নিতে পারে না। আমারে এই ঝামেলায় দেইখা উনার বিরক্ত লাগতে পারে।
আমি সাইকেল রেখে ভিসি চত্বরে ঢাবির শহীদ শিক্ষদের যে বেদীটা ওইটায় উঠে দাঁড়ালাম। এদিকে এই আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে ফেসবুকে আপডেট দিয়ে যাচ্ছি ওই মুহূর্তে হলপাড়া মানে ঢাবির সবগুলো হল শহিদ জিয়া হল, মুজিব হল, ৭১ হল, সূর্যসেন হল ইত্যাদির দিকে কি চলতেছে। যে আপডেটগুলো পরে জুলাই আর্কাইভ সংগ্রহ কইরা রাখছে।
তো এসময় এই বেদীটার চিপায় দুইটা ছেলেরে দাঁড়ানো দেখলাম, একটা হাসনাত অন্যটা সারজিস। তখনো উনারা আন্দোলনের মূখ্য নেতা হয়ে ওঠেননি। আমি খুব অবাক হলাম আন্দোলনের এই দুই স্পোক পার্সন কেমনে এতো নিরাপত্তাহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে কোনো কর্ডন নাই। কিচ্ছু নাই, জাস্ট ওরা দুইজন এবং আমি আর কয়েকটা সাংবাদিক। যে কোনো সময় তুইলা নিয়ে যাওয়া হইতে পারে তাদের।
তো হাসনাতের সামনে বুম আইনা কয়েকটা সাংবাদিক ধরছে ‘আপনি একটা ঘোষণা দিন প্লিজ’। হাসনাত বলছেন, ‘কি ঘোষণা দিবো বলেন! আমার ভাইদের এভাবে মারতেছে কি ঘোষণা দিবো বলেন।’ সাংবাদিকেরা কিছুটা জোর করলো পরেরদিনের আন্দোলনের ঘোষণাটা যেন আসে। আমি হাসনাতের চেহারায় ভয় ও রাগের মিশেল দেখলাম। চাপা স্বরে রীতিমতো আর্তনাদ কইরা উঠলেন— ‘আমার ভাইদের কি করছে দেখেন, পৃথিবীর কোথাও এমন আছে? দেখেন ভাইদের কি করছে’ বইলা। আর সারজিস কিছুটা ঠান্ডা মাথায় সাংবাদিকরে বললো ‘আমরা রাতে হোয়াটসঅ্যাপে জানাই দিবো।’
এরপর আমি ওদের ক্রস কইরা টিএসসিতে গেলাম বুকে অমিত সাহস ভর কইরা। পকেটে প্রেসের কার্ড নেই। একটা লোক নেই বাঁচানোর। কিন্তু আমি টিএসসির দিকে হাঁটলাম। সেখানে গিয়া বসলাম। ভয় শঙ্কা বুকে নিয়া টিএসসিতে একা বসে বসে পরের দিনের পত্রিকার জন্য একটা ছোট্ট কলাম লিখলাম। চারপাশে বিজিবি ও পুলিশ, যে কোনো মুহূর্তে আইসা সার্চ করতে পারে ফোনে কি করতেছি। তবুও আমি শান্ত ও ঠাণ্ডা মাথায় লিখলাম। লিখতে লিখতে ডিবি প্রধান হারুনরে সামনে দিয়ে যেতে দেখলাম আর দেখলাম সময় টিভির সাংবাদিকের হাসিমাখা মুখের বিপরীতে অন্য সাংবাদিকদের ভয় মেশানো চেহারা।
আচ্ছা সেদিন আরো অনেক ঘটনাই ঘটছিল। মেরে বাম হাতের বুড়ো ও কড়ে আঙুল ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে যা নিয়া এখনো ভুগছি। ওইটা আলাদা আলাপ। কিন্তু এই হাসনাত-সারজিসের প্রতি ওইদিনের পর থিকা মায়া জন্মে গেল। মনে হইলো— ওদের বিরুদ্ধে অল্প অল্প যে আলাপ হইতেছে (মানে ওরা যে ছাত্রলীগ ছিল.. এইসব) এইটার বিরুদ্ধে কথা বলা উচিৎ।
গ.
এরপর ৩৪ জুলাই শহীদ মিনারে সেই লাখো জনতার ভীড়ে আরেকবার হাসনাত-সারজিসকে পাশে পাই। ওইটা একটা আলাদা সময়। ডিবি হারুনের কারাগার থেকে উনাদের মুক্ত করে আনছেন আসিফ নজরুল এবং আরো আরো শিক্ষক গিয়া।
তো ওই সময় লোকেরা সেলফি তুলতে চাইছিল। হাসনাত বইলা উঠলো ‘দেশ স্বাধীন হইলে সেলফি তুলবো তখন’। আমার মনটা ভরে গেল গেল এ কথায়। দে বিলিভ ইন ফ্রিডম।
যদিও স্বাধীনতার পর উনাদের সাথে মানুষের কানেকশন নষ্ট হইছে। সম্প্রতি আসিফ মাহমুদ হেলিকপ্টারে গিয়ে বিতর্কিত হইছেন। হওয়ারই কথা। আসিফরে বুঝতে হইতো— ‘হেলিকপ্টার হুজুর’ টার্মটা এদেশে একটা নেগেটিভ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াইছে। এখন যেখানে মন্ত্রণালয়ে খরচ কমানোর জন্য প্লাস্টিকের বোতলের বদলে জগ-গ্লাস/রিইউজেবল জিনিস ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানে হেলিকপ্টার কেন? এই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। এমনকি ফেসবুকে কি জানি একটা ভিডিও শেয়ার দিছেন নিজেরে একদম হেভি দেখায়া। তাতেও বিরক্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
আমি একই ধরনের অবিমৃষ্যকারিতা করতে দেখছি মীর মুগ্ধ’র ভাই স্নিগ্ধকে। সুইজারল্যান্ড নাকি কই যাইতাছেন। আপনারে দেশের মানুষের পালস বুঝতে হবে। আপনি দিলেন হাসিমুখে ‘ফার্স্ট টাইম সুইজারল্যান্ড’ যাইতেছি এই ভাইবের একটা ছবি। কিন্তু লোকেরা এইটা ভালোভাবে নিলো না। আপনারা হইতেছেন এখন শাদা পাঞ্জাবি, গায়ে লোম পড়লেও দেখা যাবে এইটা মনে রাইখেন একটু।
আচ্ছা হ্যাঁ, জুলাই রেভ্যুলুশনের পর বারবার কথা উঠছে বিপ্লবী সরকার গঠনের। এ নিয়া শেষ আলাপটা দিতে চাই যেখান থেকে আলাপের শুরুটাও হইছিল।
ঘ.
জুলাই প্রক্লেমেইশন কথা হচ্ছে ৩১শে ডিসেম্বর। এ নিয়া ছাত্রদলের কেউ কেউ দেখলাম হাসিঠাট্টা করছেন। ক্যান করতেছেন তাও বুঝি। আন্দোলনের দুইটা ফ্রন্টকে সুকৌশলে ভাগ করে ফেলা হইছে দল গঠনের নামে। এই ফ্রন্ট দুইটা হচ্ছে জাতীয়তাবাদী ও বৈষম্যবিরোধী। আন্দোলনের পর বৈষম্যবিরোধী নামের এই সংঘের বিলুপ্তি ঘটবার কথা। নতুন নাম দিয়ে দল ঘোষণার কথা। কিন্তু সে পথে হাঁটলেন না সমন্বয়কেরা। কি সব হাবিজাবি নিয়া পইড়া রইলেন। ৫ মাসেও দল হইলো না। যত দিন গেছে আপনারা বিরক্তির কারণ হইতেছেন।
দেরিতে হলেও জুলাই নিয়া আপনারা একটা ঘোষণা আনতে যাচ্ছেন এইটা ভালো। কিন্তু তার আগেই ক্ষমতারে দীর্ঘায়িত করার একটা আলাপ দিয়া রাখছেন। এতে একজন ছাত্রদল কর্মীর মনে হতেই পারে এইটা একটা স্ট্যান্ডবাজি।
কিন্তু আমি যেমনটা বলছিলাম। আন্দোলনে যারা পুরো মন দিয়া ঝাপাইয়া পড়ছিল তাদের মন আর অন্যদের মন বিট ডিফারেন্ট হবে। তা হইতেছেও। আমি একদিকে বিপ্লবীদের নিয়া হাসিঠাট্টা নিতে পারতেছি না অন্যদিকে বিপ্লবীদের নির্বাচন নিয়া দীর্ঘসূত্রিতার আলাপেও বিরক্ত হইতেছি। ক্যান বিরক্ত হচ্ছি? না, ক্ষমতার জন্য না। নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত দেশ অস্থিতিশীল থাকবে এইটা আপনারে মনে রাখতে হবে।
তো এই জুলাই আমারে ঝামেলায় ফালায় দিয়া গেল। আমি শিবিরের লোকদের দেখছি, ছাত্রদলের শহীদদের নিয়া হাসিঠাট্টা করতে। হজম করতে পারিনাই। আমার কাছে সাথে সাথেই মনে হইছে এই লোকটা আন্দোলনে ছিল না বলেই এই ঠাট্টাটা করতে পারছে। এখন পর্যন্ত অবশ্য ছাত্রদলের কেউ শহীদদের নিয়া ট্রল করেছেন এমন দেখিনাই তবে দেখছি সমন্বয়কদের নিয়া ছাত্রদলের লোকেরা ভালোই ট্রল করছে। এটাও আমি নিতে পারতেছি না সেভাবে।
(আগেই বলছি সমন্বয়কদের কারো কারো লাগামহীন কথাবার্তায় এমন হওয়ারই কথা ছিল, বিশেষ করে সারজিস যখন সরাসরি ছাত্রদলের দিকে আঙুল তুইলা ‘চাঁদাবাজ’ হাবিজাবি বইলা ওঠে। —ভাই, তোর তো এই টোনে কথা বলা উচিৎ না!)
তো আমি এই দুই ঠাট্টাই নিতে পারি না। মনে হয় জুলাই আমারে ভালোই ঝামেলায় ফেইলা দিয়া গেল। অনেককিছু নিতে পারতেছি না।
আমার স্ট্যান্ড ক্লিয়ার,
১. এই অভ্যুত্থানে একক ছাত্রসংগঠন হিসেবে সবচেয়ে বেশি ১৪২ শহীদের দল ছাত্রদলকে যেভাবে একপাশে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে এইটা আন্দোলনের ভবিষ্যৎ ইতিহাসরে প্রভাবিত করবে। বিএনপি ক্ষমতায় আইসা নিজেদের পক্ষের ইতিহাসটাই লিখতে চাইবে এবং তাদের সেদিকেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কারণ আপনারা নিজেদের মতো করে ইতিহাস বানানো শুরু করছেন ছাত্রদলরে বাদ দিয়া। এইটা বন্ধ করতে হবে। ছাত্রদল এবং যে কোনো শহীদ ভাইদের প্রতি যার বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধা কাজ করছে তারে আমি নিতে পারতেছি না, স্যরি।
(অশ্রদ্ধা বলতে— ওই লোক ছাত্রদলের না, এইটা বলাও শহীদের প্রতি অশ্রদ্ধা। সে একটা সংগঠনের মটো ধারণ কইরা প্রাণ দিলো— মৃত্যুর পর তারে ওই দল থিকা ‘নাই’ কইরা দিলেন তা তো হইতে পারে না!)
২. জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে যা যা হবে, ভবিষ্যতে জুলাইকে জিইয়ে রাখতে যা যা ঘোষণা হবে তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাখলাম। তবে এইটা যেন ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার টুলসের একটা না হয়ে ওঠে এইটা আমাদের দেখতে হবে। বিশ্বাস করেন, আপনারা ক্ষমতা যত দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করবেন ততো জুলাই ফিকে হয়ে আসবে। যদি এই পথে পা বাড়ান একটা অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়াবেন।
জুলাইকে মরতে দিয়েন না প্লিজ, জুলাই হাসিঠাট্টার জিনিশ না। জুলাইরে না বাঁচায়া রাখলে এই দেশ তার শেকড় হারাবে যেমনটা হারাইছিল ৭১’ বেহাত হয়ে। জুলাই মরলে এদেশের ভবিষ্যৎ হবে আরো গাঢ় অন্ধকার।
Sherrif | ২৯.১২.২৪
জুলাই নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ আমাকে মুগ্ধ করেছে।
উত্তরমুছুন